“বিওয়্যার অফ দ্য ব্লব, ইট ক্রীপস
অ্যান্ড লীপস, অ্যান্ড গ্লাইডস অ্যান্ড স্লাইডস
অ্যাক্রস দ্য ফ্লোর
রাইট থ্রু দ্য ডোর
অ্যান্ড অল অ্যারাউন্ড দ্য ওয়াল,
আ স্প্লচ, আ ব্লচ
বী কেয়ারফুল অফ দ্য ব্লব”
আমার ধারণা ছিল টানেলটা বহু লম্বা হবে, যেদিক দিয়ে ঢুকব সেদিকেই সোজা এঁকেবেঁকে সাপের মতন চলবে তো চলবেই। ভুল – দেখছি এর বিস্তৃতি চতুর্দিকে। ডাইনে, বাঁয়ে, ঈশানে, নৈঋতে এ সুড়ঙ্গ ইশারায় ডাকছে তো বটেই আবার গহীনে হারিয়ে যাওয়া পাতকুয়োর তলের মতন নিচে নেমে গেছে এক দিক থেকে, নীচে নামতে ইচ্ছে না করলে ওপরেও ওঠা যায়, যদিও ওপরের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে – বহু, বহু ওপরে এক বিন্দু আলো। অবশ্য সিঁড়ি বেয়েই উঠতে হবে এরকম কোনো কথা নেই, এলিভেটর আছে, তাতে চড়তে টাকাও লাগবে না। কিন্তু যে দু’একটা কালো অবয়বে কে ওপরে উঠতে দেখলাম, কারোরই দেখলাম বেশী তাড়া নেই, ধীরেসুস্থে দেওয়ালের প্রতিটা খোঁদল দেখে নিয়ে উঠছে। “সমস্যা?” শব্দটা কোনো ধ্বনিতরঙ্গ তোলার বদলে এক ঝলক গরম হাওয়া হয়ে কানে ঢুকল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম – না ছোপ ছোপ ধরা দাঁত নেই, কন্ঠা বার হয়ে নেই, হাতে কোনো ছবিও নেই। রোগা ছিপছিপে চেহারা, হাতে ট্যাবলেট, গায়ে সোয়েটশার্ট , সঙ্গে ডেনিম জীনস। “কোথায় যেতে চান বলুন, আধ ঘন্টার মধ্যে ডিশিসন নিতে না পারলে আপনাকে রি-এন্ট্রি নিতে হবে, তবে সেটাও কয়েক মাসের আগে সম্ভব নয়; সরি অ্যাবাউট দ্যাট।” ট্যাবলেটের পর্দায় ফুটে উঠল একটা ভার্চুয়াল ট্যুর ভিডিও, “বুঝতেই পারছেন প্যানোরামিক মোড আপনাকে শুধু ব্রড ক্লাসিফিকেশন টুকুই দেখাতে পারে এই মুহূর্তে, সমস্ত অ্যাক্টিভিটিজ দেখানোর মতন কোনো প্রযুক্তি এখনো তৈরী হয়ে ওঠেনি।” ডায়গনালি চলে যাওয়া একটি সুড়ঙ্গ-শাখা থেকে ভেসে এল শকুনের চিৎকার, কিন্তু মিথ্যে স্তোকবাক্য দেওয়ার দরকার নেই, সোয়েটশার্টও জানে, আমিও জানি শকুন নয়, কচি বাচ্চার কান্নাই। মেটাফর, অ্যালিগরির স্থান নয় এ জায়গা, মিরাজ-ও তৈরী হয় না। “আপনি জানেন এই মুহূর্তে আমাদের কিছু ফাইন্যান্সিয়াল কন্সট্রেন্টস আছে, সেটা মিটে গেলেই অবশ্য আমরা ওই শাখাটি বন্ধ করে দিতে পারি। কিন্তু একটা ব্যাপারে আমরা গ্যারান্ট দি, পুরোটাই সিমুলেশন।” আমি তাকিয়ে ছিলাম অপলকে, চোখাচোখি হতেই সরিয়ে নিলাম চোখ, মনে হল একটা হাল্কা হাসি ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। জিজ্ঞাসা করলাম ভার্চুয়াল ট্যুরের জায়গায় স্বচক্ষে দেখা সম্ভব কিনা। “আধ ঘন্টায় কতটুকুই বা দেখতে পাবেন? আমাদের হিসেব অনুযায়ী এক বছরের প্রতিটি দিন চব্বিশ ঘন্টা করে দেখে গেলেও আপনি টানেল ঘুরে শেষ করতে পারবেন না।” আমি তার পরেও তাকিয়ে আছি দেখে বলল “ঠিক আছে, আপনার জন্য স্পেশ্যাল ছাড়, আসুন। তবে একটা কথা লুকোছাপা করে লাভ নেই, স্বচক্ষে দেখছেন দেখুন কিন্তু আগামী এক বছরের জন্য আপনার গতিবিধি আমাদের নখদর্পণে থাকবে।”
বাঁদিকে প্রথম মোড়টা ঘুরতেই দেখলাম একটা রঙচটা দরজা, তাতে কালচে সবুজ শ্যাওলার আস্তরণের পর আস্তরণ – ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলতে যেতে বাধা পেলাম। “আপনি নিজেই কি চান খুলতে? আপনার হয়ে আমিও খুলে দিতে পারি।” কি ভেবে নিজেই ধাক্কা দিলাম, ভেতরের বিলাসবহুল বিশ্রামাগার, অজস্র জীব মাটিয়ে শুয়ে, কুঁকড়ে আছে, দুমড়ে আছে, মুখগুলো সেকন্ডে সেকন্ডে বিকৃত থেকে বিকৃততর হচ্ছে । ক্রিস্ট্যাল মেথের ধোঁয়ার মধ্যে একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছিল, একটু সরে দাঁড়িয়ে দেখলাম – না, মানুষ-ই। বেরিয়ে এসে সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম মেজানিন ফ্লোরে, একটা সাদা কিউবের মধ্যে একটা টেবল, সেখানেও আরেক সোয়েটশার্ট – এটার নাম শুধুই “সার্ভিস সেন্টার”। চোখে পড়ল মাইকেল পাওয়েলের সেই বিখ্যাত পোস্টার,
“আপনি নাম, আই-পি অ্যাড্রেস দিয়ে দিলে আমরা আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে ডেলিভারী দিয়ে দেব। ওয়েবক্যাম থাকলে আমাদের কোডিং-এ অনেক সুবিধা হয়, আপনার কাজটাও স্মুদলি হবে। না থাকলেও অসুবিধা নেই, তবে টাকা এবং সময় দুটোই বেশী পড়বে।” ঘুরে ডানদিকে যেতেই একদল টীন-এজার, সবাই সোয়েটশার্ট পড়ে, তারা ছবি মরফ করে চলেছে। মরফিং সেন্টারের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলাম, আমার গাইডের ইঙ্গিতে চোখ রাখতে হল দেওয়ালে রাখা পঞ্চান্ন ইঞ্চির পর্দায়। মেরুদন্ড দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল – আমার বোন, আমার দিদি, আমার স্ত্রী। “চিন্তা করবেন না, এক মাসের মধ্যেও যদি আপনি ওয়ার্ক- অর্ডার দিতে পারেন, পাঁচ বছরের মধ্যে কারোর জিম্মায় এগুলো যাবে না – আপনি জানেন এ গ্যারান্টি একবার পেয়ে গেলে টানেলের-ও কারোর পক্ষে সেটা রিভোক করা সম্ভব নয়।” কপালটা ঘেমে উঠেছিল, মুছতে গিয়ে দেখি হাতের আঙ্গুলগুলো চটচট করছে, সেই অদ্ভুত কালচে সবুজ শ্যাওলাটা কখন জানি লেগে গেছে হাতে। একটা গমগমে আওয়াজ শুনে ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখি টানেল-ট্রেন রিসিভিং স্টেশনে এসে পৌঁছল – ক্রেট ক্রেট মাল স্টেশন লাগোয়া এলিভেটর দিয়ে সোজা ওপরে উঠতে লাগল, সেই এক বিন্দু আলোর দিকে। “মিলিটারী ডিলস, এর বেশী কিছু বলা যাবে না; আসুন বরং প্লেরুমে যাই, নেক্সট রাউন্ড আর দু মিনিটে শুরু হবে।”
প্লেরুম দোতলায়, কিন্তু সেখানে ঢোকার উপায় নেই, বাইরে থেকেই দেখতে হবে। লালচে নিওন লাইটে দেখা গেল পাঁচজন লোক গাই ফকসের মুখোশ পরে বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে, বাইরে থেকে তাদের কাঁধের ওপর থেকেই শুধু দেখা যাচ্ছে। বাইরে অবশ্য অস্বাভাবিক ব্যস্ততা, কম্পিউটারের স্ক্রীনে স্ক্রীনে ফুটে উঠছে টাকার অঙ্ক, স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যস্ততায় সোয়েটশার্টরা অর্ডার নিতে ব্যস্ত। “বেটিং, লাইভ” গাইডের কথা শেষ হতে না হতেই একটা গং আওয়াজ কানে ভেসে এল। ভেতর দেখা গেল পাঁচ মুখোশধারী একে অপরের মাথায় নিশানা করেছে মসৃণ পালিশের আগ্নেয়াস্ত্র। “রাশিয়ান রুলেট নিশ্চয় আগে দেখেছেন, অ্যাড্রিনালিন টাইম।” তিন নম্বর লুটিয়ে পড়ল, আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। “আজকের গেমটা একটু স্পেশ্যাল ছিল, ফিক্সড, প্লীজ এদিক দিয়ে আসুন”, আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে উত্তর এল “স্পাইদের নিয়ে খেলতে কার না ভালো লাগে বলুন?” দোতলায় মিনিট দশেক আরো হাঁটার একটা চকিত বাঁক, আরো একটা দরজা। “আসুন, এখানে দেখতে পাবেন আমাদের ক্রেম ডেলা ক্রেমদের।” আরো এক ঝাঁক সোয়েটশার্ট, দ্রুতগতিতে চলছে কোডিং, সামনের বিশাল স্ক্রীনে ফুটে উঠছে ডিজিট্যাল লেজারের হিসেবনিকেশ। “জানেন নিশ্চয়, টানেলে ডলার, ইউরো, পাউন্ড কিছুই চলবে না, চলবে শুধু বিটকয়েন। কম্পিটিশন এত বেড়ে গেছে, দিনে তিনটের বেশী বিটকয়েন বানানো বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। আমাদের পারফরম্যান্স অবশ্য মাচ বেটার, বিটকয়েনের হিসাবে বেশ কিছু বিলিয়ন ডলার আমাদের কাছে মজুত। সুতরাং, আপনি কোনো কাজ করতে চাইলে ফাইন্যান্সিয়াল কারণে সেটা না হওয়ার চান্স প্রায় নেই।” বলতে বলতে হাতের ট্যাবলেটে বেজে উঠেছেদ, সময় শেষের সঙ্কেত।
আমি ঘাড় নাড়লাম, বাঁদিক থেকে ডানদিকে, ডানদিক থেকে বাঁদিকে। সোয়েটশার্ট হাসল, এক ঘন্টা আগেই জানত আমি কিরকম ভাবে ঘাড় নাড়াব। কিন্তু হাসিটা সেজন্য নয়, ও জানে আলোয় ফিরে গিয়েও স্বস্তি নেই, কালচে সবুজ শ্যাওলায় টানেল ছেয়ে গেলেও আবার কোনো একদিন অন্ধকারের মুখোমুখি হতে মন ছটফট করবে। কোনো এক দুঃস্বপ্নের রাত্রে শকুনের চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে গেলেও শরীর জুড়ে চটচটে অস্বস্তি মনে করিয়ে দেবে বহু নীচে চলছে অমানুষী মাইটোসিস, আরেক পৃথিবী বেড়ে চলেছে অস্বাভাবিক দ্রুততায় ।
(কৃতজ্ঞতা – http://content.time.com/time/magazine/article/0,9171,2156271,00.html?pcd=pw-edit)