ইউনিভার্সিটি থেকে প্রত্যেক ফ্যাকাল্টি মেম্বার-ই একটি করে ল্যাপটপ পান, আমিও পেলাম। পেয়েই চক্ষু চড়কগাছ, কীবোর্ডটি টার্কিশ ভাষীদের জন্য বানানো।তবে যতটা রিঅ্যাক্ট করলাম ব্যাপারটা আদতে অতটাও খারাপ নয়। শ্রীল শ্রীযুক্ত আতাতুর্ক মহোদয়ের দৌলতে টার্কিশ অ্যালফাবেট-ও মূলত ল্যাটিন, সাতটি অক্ষর খালি উচ্চারণের সুবিধার্থে মূল ল্যাটিন অক্ষরের ওপর একটু কারিকুরি করে গড়ে তোলা হয়েছে। একদিকে যেমন কিউ, ডবলিউ এবং এক্স টার্কিশ অ্যালফাবেটের মধ্যে পড়ে না, উল্টোদিকে আবার ল্যাজওলা সি, ল্যাজওলা এস, লোয়ারকেসে ফুটকিবিহীন আই বা দু’দুটো ফুটকিওলা ও কে পেয়ে যাবেন। মুশকিলটা মূলত হচ্ছে এই ফুটকিবিহীন আই কে নিয়ে। ইনি বসে আছেন আমাদের ইউসুয়াল কীবোর্ডে ফুটকিওলা আইয়ের জায়গায়। তাই শেষ ক’দিন ধরে ভারত, আমেরিকা এবং পৃথিবীর অন্য যেসব জায়গায় অফিসিয়াল ই-মেল ছাড়তে হয়েছে, তাতে আই বাবাজীবন ‘বিন্দু’বিসর্গ জানাচ্ছেন না। মজাটা হল অন্য দেশের লোকেরা এটা বোধহয় লক্ষ্যও করেন নি কিন্তু তুর্কী কলীগরা একটু কনফিউসড। হয়েছে কি, ফুটকিবিহীন আই-এর উচ্চারণটা খানিকটা অ্যা এবং খানিকটা ই-র ওয়েটেড কম্বিনেশন বিশেষ। তাই Prabirendra না লিখে Prabırendra লিখলে প্রব্যারেন্দ্র এবং প্রবেরেন্দ্রর মাঝামাঝি কিছু শোনাবে। তাই ওনারা একটু চিন্তায় পড়েছেন, ব্যাটা সাতদিন যেতে না যেতেই কি অ্যাক্সেন্ট মারছে দেখো! গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে ল্যাজওলা সি’র প্রতি আমার নিখাদ প্রেম। সি’র ল্যাজ গজালেই আপনাকে ‘zi’ বলতে হবে। পরশুরাম বেঁচে থাকলে গিয়ে বলে আসতাম ” শেষমেষ ‘z’ান্তি পেরেছি স্যর”! তো ভালোবাসায় দিগ্বিদিক ভুলে ‘জী, জী’ করে যাচ্ছি, c/si/j/z কেউ ছাড় পাচ্ছে না।
সবে সপ্তাহখানেক হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছেড়েছি কিন্তু তাতেই ওজন এবং আকৃতি নিয়ে ব্রেন বড় ঝামেলায় পড়েছে। সবই বেজায় ছোটো ছোটো লাগছে। মানুষজনের কথা ছেড়েই দিলাম, আলুর সাইজ দেখে ভাবছি সেপ্টেম্বরেই বাজারে নতুন আলু উঠে এসেছে? তাড়াহুড়োতে এয়ারপোর্টে চশমাটা হারিয়ে এসেছি তাই কাক এবং পায়রা চোখে পড়লেই মনে হচ্ছে নতুন চশমা বানানোটা নিতান্তই দরকার। এমনকি ক্যাম্পাসের চেরি ফলের গাছ দেখে ভাবছিলাম নতুন কোনো বেরি বোধহয়। মোদ্দা কথা হল, দৈত্যাকৃতি আমেরিকান পশু-পাখী, গাছপালা এবং জড়পদার্থ না দেখতে পেয়ে চমকে চমকে উঠছি আর স্বপ্নে গার্জিয়ান এঞ্জেল এসে বলে যাচ্ছেন “এটাই বাস্তব, ওটা জেনেটিক এঞ্জিনীয়ারিং-এর কেরামতি।” কালকে একটু তো তো করে বলেই ফেললাম “যাই বলুন, ও দেশে কিন্তু একটা আপেল টেবলের ওপর রেখে দিলে একটুও না টসকিয়ে মাস তিনেক থেকে যেত।” উলুবনে আর কত মুক্তো ছড়ানো যায় বলতে বলতে বিরক্ত হয়ে চলে গেলেন। বলতে ভুলে যাচ্ছিলাম ল্যাজ, শিং নিয়ে টকটকে লাল রঙের শয়তান-ও দেখা দিয়ে যাচ্ছেন; বেশি বিরক্ত করছেন না, খালি বলছেন “পাইরেট বে“।
জীবজন্তুর কথা প্রসঙ্গে বলি ইস্তানবুলের বেড়ালরা প্রায় বিশ্ববিখ্যাত। তাদের ক্যামেরাবন্দী করার জন্য দেশ-বিদেশ থেকে লোকেরা আসেন। অতি সম্প্রতি টাম্বলারেও তুর্কী মার্জারকুলের দেখা পাওয়া যাচ্ছে । ইস্তানবুলের রাস্তায় মেলা বেড়াল দেখতে পাবেন – সিংহের মতন কেশর নিয়ে পার্সিয়ান বেড়াল, ‘মাস্টার অ্যান্ড মার্গারিটা’র কভার থেকে উঠে আসা কালো কুচকুচে বেড়াল, ইনসাইড-আউট ক্যাট এবং আর যা যা চাই। ক্যাম্পাসে অত বৈচিত্র্য নেই বটে, কিন্তু তেনারা সর্বত্র বিরাজমান। ক্যাফেটেরিয়া, লাইব্রেরী, ডরমিটরি তে তো বটেই কালকে দেখলাম এক দুধে-আলতা রূপসী সেমিনার রুমেও ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রথম দিন পৌঁছনোর পর সর্বপ্রথম অভ্যর্থনা জানাতেও এঁদেরই একজন উপস্থিত ছিলেন। বিদেশী বলে ভ্রূক্ষেপ অবধি না করে পায়ে মাথা ঘষতে শুরু করেছিলেন তারপর অবশ্য সেই কাজটাই সুটকেসের সঙ্গে করতে গিয়ে দু’জনেই সশব্দে পপাত চ । তাতে অবশ্য একটা কাজের কাজ হল, আমার পড়শীরা টের পেলেন “ভুবন ভ্রমিয়া শেষে…” ইত্যাদি ইত্যাদি। ফ্যাকাল্টি হাউসিং-এ যাতে ঢুকে না পড়েন, সেটা এনসিওর করতে গিয়ে চার রাউন্ড চু-কিতকিত খেলে জিততে হল কিন্তু এ শুনে পরাভূতকে অবহেলা করবেন না। কাঁচের দরজার এদিক থেকে দেখি রণে ভঙ্গ না দিয়ে তিনি পেছনের দু পায়ে দাঁড়িয়ে সামনের দু’পা দিয়ে দরজার হাতল ঘোরাচ্ছেন। বিশ্বাস করুন, টানছেন না, ঘোরাচ্ছেন – দেখে চক্ষু স্থির এবং সার্থক দুটোই হল। মনে পড়ল বহু যুগ আগে ‘সৃষ্টি‘র বেড়াল সংখ্যার জন্য একটা ছড়া লিখেছিলাম,
অথ মার্জার ঘটিত
একটি পুষি ঘুমকাতুরে, আরেক মেনি ছোঁচা ;
ঠিক দুপুরে আসেন হুলো গোঁফটি খোঁচা খোঁচা।
কত আবদার, কত ডাক তার – কিছুতেই নেই তুষ্টি
তবু মা বলেন,
“আহা ষাট ষাট, মা ষষ্ঠীর গুষ্ঠী”।
একটি বিল্লী দুধসাদা এবং মিশকালোটিও জাতভাই,
পাটকিলে যিনি সকালে আসেন, বরাদ্দ দুধ চাই-ই চাই।
সুযোগ পেলে মন দ্যান তিনি দু’টুকরো মাছ পাচারে,
তবু মা বলেন,
“আহা ষাট ষাট, মা ষষ্ঠীর বাছা রে”।
মার্জারকুলনন্দিনী আসেন ডিনার সারতে রাত্রে,
গোঁসা হয় ভারী, যদি না ধরি খাদ্য সাজিয়ে পাত্রে।
অভিমানী ভারী, সাধ্য-সাধনায় করেন অন্ন ধ্বংস,
তবু মা বলেন,
“আহা ষাট ষাট, মা ষষ্ঠীর বংশ”।
তিতিবিরক্ত হয়ে তাই বলি কৃপা কর দেবী আর নয়,
নিত্যিদিনই মার্জারকুলের এই উৎপাত কার সয়?
চড়ালাম ফুল, বুঝলেন ভুল, ছিলেন কি জানি কি ঘোরে,
মা বলে যান,
“দেবীর কৃপায় কোলটি গিয়েছে ভরে”।
সেই কথাই বলছিলাম আর কি, ষষ্ঠী যদি কোনো জায়গার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হন তো সে এই ইস্তানবুল!
(স্থিরচিত্র উৎস – Daily Cat Istanbul)
Aha , pore monta akuli bikuli hoye gelo go … apnar sonar kolom hok go !!!
LikeLike
আপাতত পুরস্কার হিসাবে আপনার কয়েকটা বই পেলেই ভারী বাধিত বোধ করব 🙂
LikeLike
Lekha gulo boi obosthae jeno dekha dey!
LikeLike
berey lekha, share korchhi 🙂
LikeLike
চূড়ান্ত ভাল লাগল … (একটু কিন্তু কিন্তু বোধে) কবিতাটির কপি রাখতে পারি? বড্ড ভাল লেগেছে…
LikeLike
শকুন্তলা দি – যাক, এক কপি বিক্রির বন্দোবস্ত হল!
অর্ঘ্য – অনেক ধন্যবাদ!
সই – একশোবার, এ আর জিজ্ঞাসারই বা কি আছে। শুনে আমারও বড় ভালো লাগল।
LikeLike